সারাদিন যাও কাটে রাত হলে বিছানার লাগোয়া জানালা দিয়ে হলের সেই লাইট জ্বলা রুমটা চোখের সামনে চলে আসে। ছেলেটা রোজ করিডোরের রেলিঙে এসে আমার জানালার দিকে বিষণ্ণভাবে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখের আলো যেন রোজ বাড়ছে! আমি বাসার কাউকে কিছু বলতে পারি না। গলা ব্যথা, কাশি বেড়ে আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে বাধ্য হয়ে টেস্ট করাতে খবর দেওয়া হলো। ৬ষ্ঠ দিনে স্যাম্পল নেওয়া হলো। তখন আমি রীতিমতো যুদ্ধ করছি নিজের সাথে। বাসার সবাই সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে জানপাত করছে আমার জন্য। অসুস্থ না হলে বুঝতাম না এতো ভালোবাসা আছে মানুষগুলোর ভেতরে। সারাটা জীবনের সব বঞ্চনা এবার ভুলে গেলাম।
শেষ ওকে দেখেছিলাম ৬ষ্ঠ দিনের রাতে। করিডোরে দাঁড়িয়ে খুব কাশছিল! অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মুখ দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে ঠোঁটের কোনায় দেখা যাচ্ছে! আমি জ্ঞান হারাচ্ছিলাম বার বার, শ্বাসকষ্টে আমাকে বাসাতেই অক্সিজেন সাপ্লাই দেওয়া হলো।
২.
তাঁরা তিনজন আদ্রে, মিশায়েল আর লিনক্স মাত্রই নতুন একটা গ্রহে অবতরণ করেছে। স্পেসশিপ থেকে নেমেই উটকো গন্ধ নাকে ঝাপটা দিলো। পচা মাছের মতো! তারমানে এখানে ফসফিন গ্যাস থাকতে পারে। বিষয়টা নিশ্চিত হতে মিশায়েল স্পেসশিপ থেকে গ্যাস পরিমাপ করার যন্ত্রটি সাথে নিয়ে নামলো। তাঁরা ওখানে হাঁটতে গিয়ে খেয়াল করলো গ্রহটা মরচে পড়া লাল। অনেকটা মঙ্গলগ্রহের মতো। কিন্তু এখানে কোথাও কোন পানি বা জীবনের চিহ্ন নেই। একটা মরা গাছকে দেখলে যেমন বোঝা যায় যে এখানে পানি বা প্রাণ ছিলো তেমনি গ্রহটাতে একটা মরা গাছের মতোন একটা ভাব আছে। যদিও দেখলে মনে হয় এখানে কোন পানি অথবা প্রাণ কখনো ছিলো না। কেমন একটা প্যারাডক্সের মতো!
দূরের জিনিস যেমন দিগন্তের মতো সমান না একটু উল্টাপাল্টা তেমনি পাহাড় হিমালয়ের রেঞ্জের চেয়ে কয়েকগুন বড়। এর আগে সব সমান। গ্রহের উপরের সারফেসের সমান। কিন্তু সারাটা জায়গা জুড়ে পাথর যা সারফেসের রংয়ের মতো। গ্রহের একটা মজার ব্যাপার হলো পাথরগুলো একই রংয়ের হওয়াতে গ্রহটাতে নামলো যখন তখন তারা দেখলো যে এখানে অন্য গ্রহের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হচ্ছে না। তারমানে এখানকার গ্রাভিটেশনাল ফোর্স পৃথিবীর গ্রাভিটির কাছাকাছি। এজন্য তারা হাঁটাচলা করতে পারছে। কিন্তু তাদের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে অসম সব পাথরের কারণে এতো ভারি স্পেস স্যুট পরে।
যদিও তারা দেখতে পাচ্ছে যে কোথাও কোন প্রাণি নেই। কোথাও পানি নেই তাই প্রাণি থাকার প্রশ্ন না ওঠার পরেও তাদের মনে হচ্ছে কেও তাদেরকে দেখছে।
একটু পর তারা খেয়াল করলো মাটির নিচ থেকে একটা আজব আওয়াজ আসছে। শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। হঠাৎ করে মনে হবে ইঞ্জিনের ঘড়ড় ঘড়ড় শব্দ। কিন্তু মেশিনের ইঞ্জিনের শব্দ এতো মোলায়েম হয় না। ঘড়ড় ঘড়ড় হয়। আবার মনে হবে এটা গীর্জার কোরাসের শব্দ। কিন্তু শব্দটা ঠিক কোরাসের মতো এতো সুন্দর না। কেমন যেন রোবটিক। শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। তখন তাদের স্পেসশিপে ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজা শুরু হয়ে গেছে। তাদের এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) চিৎকার করছে তাড়াতাড়ি স্পেস শিপে উঠতে। ইমর্জেন্সি সাইরেন শুনে আদ্রে, মিশায়েল আর লিনক্স তিনজনই দৌঁড়ানো শুরু করলো কিন্তু স্পেসস্যুট অনেক ভারী আর পথ অনেক পাথুরে হওয়ায় তারা ঠিকমতো দৌঁড়াতে পারছে না। তখন তাদের তিনজনের মধ্যে মিশায়েল হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। সে যখন ওঠে দাঁড়াল তখন দেখলো যেই পাথরটাতে আছাড়া খেয়েছে সেই পাথরটা খুব আস্তে আস্তে বাড়ছে। সে পাথরটা তার হাতে নিলো। কৌতুহলের চোটে সে তার ইমার্জেন্সি স্পেশশিপে ওঠার কথা ভুলে গেছে। আর বাকীরা একটু পরে স্পেশশিপে যাওয়ার পথে খেয়াল করলো তাদের সঙ্গী মিশায়েল তাদের সাথে নেই।
মিশায়েল দেখলো অদ্ভুত ডিজাইন করা একটা পাথর এবং এও দেখলো তার চারপাশের সব পাথরই গভীর থেকে জ্বলজ্বল করা শুরু করেছে। সেখানকার মাটিও জ্বলজ্বল করছে।
তখন তাদের স্পেশশিপ থেকে এআই ভয়ঙ্করভাবে চিৎকার দিলো “তোমরা জলদি স্পেশ শিপে ফেরত আসো। ওরা ভাইরাস! তোমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে গেছে !”
৩.
সেপ্টেম্বর ২০২০ এর একটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, করোনা ভাইরাসের সফল, কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন এখনো বাজারে আসেনি কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়েই অগ্রীম কোটি কোটি ডোজ কিনে রাখছে ধনী দেশগুলো।
দাতব্য সংস্থা অক্সফামের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধনী দেশগুলো তাদের সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের উৎপাদন সক্ষমতার ৫১ শতাংশই কিনে ফেলেছে। অথচ ওই উন্নত দেশগুলোতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষের বসবাস।
ধনী দেশগুলোর এরকম টানা হ্যাঁচড়ার কারণে আবিস্কারে এগিয়ে থাকা ৫/৬টি ভ্যাকসিনও যদি সফল হয় তবু ২০২২ সালের আগে বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ বা ৬১ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিতে পারবে না বলে সতর্ক করেছে অক্সফাম। আবিস্কারে এগিয়ে থাকা প্রথম কয়েকটি ভ্যাকসিনও যদি নিরাপদ প্রমাণিত এবং সফল হয় তারপরেও এ অবস্থা সৃষ্টি হবে বলে সতর্ক করে অক্সফাম।
চলমান জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের শুরুতে দেয়া বক্তব্যে ভ্যাকসিনের আলাদা চুক্তিকে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ উল্লেখ করে একে অন্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন মহাসচিব। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, সকলে নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত করোনা ভাইরাস থেকে কেউ নিরাপদ নয়।
এর মধ্যে খবর পাওয়া গেছে ব্রাজিলে ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে একজন মারা গেছে। যদিও এর সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি যে ব্যক্তিটি আসলে কী কারণে মারা গেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২১ এর মাঝামাঝি সময়ের আগে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করার মতো কোন ভ্যাকসিনের আশা এখনও করতে পারছে না।
৪.
সফল অবতরনের পর মিশায়েল তার সংগ্রহ করা জীবিত পাথর অর্থাৎ ভাইরাসটিকে অক্সফোর্ডের গবেষণাগারে চিকিৎসা গবেষণায় নিয়োজিত বাংলাদেশী চিকিৎসক নাবিলা নুরের কাছে হস্তান্তর করলো। নাবিলার কাজ ছিলো চিকিৎসা গবেষণায় ভাইরাসটিকে পরীক্ষা করা এটি প্রাণিদেহে কী প্রভাব ফেলে তা যাচাই করা। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো এটির আবরণ থেকে গদা-আকৃতির প্রোটিনের কাঁটাগুলির কারণে এটিকে অনেকটা মুকুট বা সৌর করোনার মত দেখায় অর্থাৎ কিছুটা করোনা ভাইরাসের মতো দেখতে। যা বর্তমান সময়ের করোনা ভাইরাসজনিত প্যানডেমিকে নতুন কোন পথ দেখাতে পারবে বলে আশা করা যেতে পারে। এখন করোনার মতো দেখতে নতুন এই ভাইরাসটিকে পরীক্ষা করতে স্বেচ্ছাসেবী দল প্রয়োজন যাদের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিষয়টা লিখতে যতোটা সহজ বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে ততোটা সহজ হয়নি। কারণ একেবারে অজানা একটি ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করানো হচ্ছে। যে কোন ধরণের দূর্ঘটনার জন্য মানসিকভাবে গবেষকদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ এক বিশাল মানসিক চাপ।
৫.
৮মদিনে আমি যেন একটু ধাতস্থ হলাম। শ্বাসকষ্টের মাত্রা কমতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার পর চোখ গেল সেই করিডোরে। নাহ কেউ নেই। সব অন্ধকার, শুনশান!
আমার রিপোর্টে নেগেটিভ এসেছে। কিন্তু একটা খবরে চোখ আটকে গেল! ওই হলের ওই রুম নম্বরের এক শিক্ষার্থী মারা গেছে আমি যেদিন প্রথম জ্বরে আক্রান্ত হলাম।
আমার সারাগায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। তবে কি বিরান ওই হলে ওই ছেলেটার আত্মা ছিল একয়দিন! আসলেই কি তাই !? আমি আসলে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলাম আমার কন্যা নাবিলার জন্য। কারণ নাবিলা বর্তমান মহামারী থেকে পরিত্রাণের জন্য অক্সফোর্ডের ল্যাবরেটরিতে কাজ করছে। আমার মন সারাক্ষণ সেখানেই নিজের সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তায় থাকে।
৬.
২০২২ সালের নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা এলো। যৌথভাবে আরেক ইংরেজ চিকিৎসকের সাথে আমার কন্যার নাম এসেছে। করোনার মতো মহামারী ঠেকিয়ে দেওয়া ভ্যাকসিন আবিস্কারের জন্য মানবতার কল্যাণে অবদান রাখতে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আমি যখন শেষের এই কয়েক লাইন লিখছি একজন মা হিসেবে চোখের পানি ধরে রাখা কতোটা যে কষ্টকর তা কেবল একজন সফল মাই বুঝবেন। আজ আর আমার কোন কষ্ট নেই। নারী হিসেবে যে বঞ্চনা, গঞ্জনা সয়ে নিজের সন্তানকে কন্যা হিসেবে নয় বরং মানুষ হিসেবে বড় করতে চেয়েছি তাতে আজ আমি পৃথিবীর সফলতম মা হতে পেরেছি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
বর্তমান দূর্যোগে বিজ্ঞান কীভাবে মানব কল্যাণে কাজ করতে পারে তা নিয়ে নীরবে, বিরাণে থাকা একজন সফল মায়ের কথায় ওঠে আসা কথামালাতে লেখকের কল্পনাপ্রসূত এই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি।
২৮ মার্চ - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
২২ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.২২
বিচারক স্কোরঃ ২.২২ / ৭.০পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।